প্রাথমিকভাবে সচেতনতা বৃদ্ধি ও ক্যান্সার নিরূপণে কাজ করবে এই ফাউন্ডেশন, ভবিষ্যতে লক্ষ্য আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত ক্যান্সার হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করা। ‘রোজার শুরু, জুম্মার দিন, আজ আর আমার জন্মদিন’- ছোট্ট ছড়ায় কথা শুরু করলেন সাকিব আল হাসান। শুরুটা মজায় হলেও আয়োজনটি দারুণ গুরুত্বপূর্ণ। জন্মদিনকে বিশেষ করে রাখার উদ্যোগের কথা জানালেন তিনি। বিচ্ছিন্নভাবে নানা সামাজিক কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকা সাকিব এবার প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শুরু করলেন ক্যান্সার ফাউন্ডেশন।
রাজধানীর একটি হোটেলে শুক্রবার বিকেলে আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হলো সাকিব আল হাসান ক্যান্সার ফাউন্ডেশনের। মহতী এই উদ্যোগের পথচলা শুরুর জন্য বেছে নেওয়া হয় বাংলাদেশের টেস্ট ও টি-টোয়েন্টি অধিনায়কের ৩৬তম জন্মদিনকে। সাকিবের শৈশবের ক্রিকেট গুরু ও দেশের ক্রিকেটের শ্রদ্ধেয় কোচ নাজমুল আবেদীন ফাহিমের সঞ্চালনায় উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ফাউন্ডেশনের সদস্যরা ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন বিসিবি সভাপতি নাজমুল হোসেন, বিসিবি পরিচালক ওবেদ রশীদ নিজাম এবং ক্রিকেটারদের মধ্যে রকিবুল হাসান, সানোয়ার হোসেন, হাবিবুল বাশার, জাভেদ ওমর, সানজামুল ইসলামরা কয়েকজন।
প্রাথমিকভাবে ক্যান্সারের ব্যাপারে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে কাজ করবে সাকিবের এই ফাউন্ডেশন। ওয়েবসাইট (https://shakibalhasancancerfoundation.org/) থেকে পাওয়া যাবে এই বিষয়ক নানান সেবা। দীর্ঘ পরিসরে এই ফাউন্ডেশন নিয়ে আরও পরিকল্পনা আছে সাকিবদের।
সাকিবের নামে করা হলেও এই ফাউন্ডেশনের পেছনে মূল উদ্যোক্তা বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৯ দলের সাবেক অধিনায়ক কাফি খান। ২০০৩ সালে যুবাদের নেতৃত্ব দেওয়া কাফি বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রাক্তন শিক্ষার্থী। এই ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন তিনি।
বিকেএসপির কোচ ও প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা মিলেই শুরু করেছেন এই ফাউন্ডেশন। কাফি-সাকিব ছাড়া ফাউন্ডেশনের অন্য সদস্যরা হলেন বিকেএসপির দুই কোচ নাজমুল আবেদীন ও সারওয়ার ইমরান এবং বিকেএসপির প্রাক্তন শিক্ষার্থী জাতীয় ক্রিকেটার আব্দুর রাজ্জাক, নাঈম ইসলাম, সোহরাওয়ার্দী শুভ, নাসিরুল ইসলাম। ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করা সাবেক ক্রিকেটার মোশাররফ হোসেন রুবেলও ছিলেন এই উদ্যোগের অংশ।
সাকিবের জন্মদিনে যাত্রা শুরু ক্যান্সার ফাউন্ডেশনের এই ফাউন্ডেশন শুরুর পেছনের গল্পটাও হৃদয়স্পর্শী। ২০১৬ সালে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান বিকেএসপিতে কাফির সহপাঠী ও দীর্ঘ দিনের বন্ধু জাফর সাদেক (রাসেল)। ওই বছরের মে মাসে ক্যান্সার ধরা পড়ার পর খুব বেশি সময় পাননি জাফর। শুরুতে জানতে পারলে হয়তো আরও সচেতন হতে পারতেন তিনি ও তার পরিবার- এই ভাবনা থেকেই মানুষকে সচেতন করার লক্ষ্যে ক্যান্সার ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠার ভাবনা আসে কাফির।
তার এই মহৎ ভাবনায় শুরু থেকেই ছিলেন নাজমুল আবেদীন, সারওয়ার ইমরান, নাঈম, সোহরাওয়ার্দীরা। পরে সাকিবের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে সাগ্রহে এগিয়ে আসেন বাংলাদেশ ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন। সাকিবকে পাশে পাওয়ার পর ত্বরান্বিত হয় ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠার কাজ। ফাউন্ডেশনের নিবন্ধনও করা হয়ে গেছে।
প্রাথমিকভাবে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি ও ক্যান্সার নিরূপণে কাজ করবে সাকিব-কাফিদের এই ফাউন্ডেশন। দীর্ঘ মেয়াদে সকল আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত ক্যান্সার হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা রয়েছে তাদের।
নিজের জন্মদিনে এমন একটি উদ্যোগের শুরু করতে পারায় লিখিত বক্তব্যে কাফি খানকে ধন্যবাদ জানান সাকিব। পাশাপাশি ফাউন্ডেশনের সঙ্গে থাকা সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন তিনি। “রোজার শুরু, জুম্মার দিন, আজ আর আমার জন্মদিন। এক দিনে সব মিলে গেছে তাই দিনটি আমার জন্য আলাদা। আলাদা আরও একটি কারণে, আমাদের এই নতুন উদ্যোগের কারণে। আমি অনেক সময় অনেক কিছুর সঙ্গে জড়িয়েছি, চেষ্টা করেছি মানুষের পাশে থাকার। এবার প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কিছু করতে চাই। এই ক্যান্সার ফাউন্ডেশন করার পেছনে সত্যিকার অর্থে সেটিই কারণ।” “ক্যান্সারকে সবাই মরণব্যাধি বলে। তবে এর ভয়ে পিছিয়ে থাকলে চলবে না। এর বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে, মানুষকে সাহস দিতে হবে, আশা দেখাতে হবে। আমরা সবাই মিলে সেই কাজটি করতে চাই। যত ক্ষুদ্র পর্যায়ে থেকেই হোক না কেন।” ফাউন্ডেশনে কর্মপরিধি সম্পর্কেও ধারণা দেন সাকিব।
“সাকিব আল হাসান ক্যান্সার ফাউন্ডেশন সেইসব মানুষের জন্য কাজ করতে চায়, যাদের সামর্থ্য নেই ক্যান্সারের মতো ব্যয়বহুল চিকিৎসাকে এগিয়ে নেওয়ার। আমরা যদি একজন, একশ জন বা এক হাজার জন মানুষকেও সাহায্য করতে পারি, সেটিই আমাদের জন্য বড় অর্জন হবে আমি মনে করি।” “আমাদের স্বপ্নটা বড়, একটা ক্যান্সার হাসপাতাল করার। যেখানে পরিপূর্ণ আধুনিক চিকিৎসার সকল সুবিধা থাকবে। তবে একদমই কম খরচে। মানুষ যে হাসপাতালে এসে হাসি মুখে বাড়ি ফিরবে। গর্ব করে বলবে, বাংলাদেশেও এমন একটি হাসপাতাল আছে। যা ছড়িয়ে পড়বে দেশ ছাড়িয়ে বিশ্বের বিভিন্ন পর্যায়ে। স্বপ্নটা বিশাল। হয়তো এখনই সম্ভব নয়। তবে একদিন নিশ্চিত হবে ইনশাআল্লাহ্। তার আগে চাই একটা ডায়াগোসিস সেন্টার করতে। তারও আগে চাই মানুষের মাঝে সচেতনতা বাড়াতে। আমার কাছে মনে হয় এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।” এ সময় ক্যান্সার সম্পর্কে নিজের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথাও জানান সাকিব।
গত দুই বছরে তার স্ত্রী উম্মে আহমেদ শিশিরের বাবা-মা দুজনই মারা গেছেন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে। একটি ভিডিওবার্তায় নিজের ওই কষ্টের সময়ের কথা বলেন শিশির। পাশাপাশি ক্যান্সার ফাউন্ডেশনের গুরুত্বও তুলে ধরেন তিনি।
সাকিবের জন্মদিনে যাত্রা শুরু ক্যান্সার ফাউন্ডেশনের শিশিরের মতো ক্যান্সারে আপনজন হারিয়েছেন জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক ও বর্তমান নির্বাচক হাবিবুল বাশার। মরণব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে মারা যান তার বড় ভাই কাজী ইকরামুল বাশার। নিজের বক্তব্যে তিনি বলেন, দুঃসহ ওই সময়ের কথা তিনি মনে করতে চান না। ক্যান্সার ফাউন্ডেশন করায় এর সঙ্গে জড়িত থাকা সবাইকে সাধুবাদ জানান তিনি।
বিসিবি সভাপতির দায়িত্বের বাইরে বাংলাদেশ ঔষধ শিল্প সমিতির সভাপতি নাজমুল হাসান। নিজের অবস্থান থেকে সাকিবদের ক্যান্সার ফাউন্ডেশনের যথাসম্ভব পাশে থাকার আশ্বাস দেন তিনি। “ক্যান্সারের ক্ষেত্রে সচেতনতা, শুরুর দিকে ধরতে পারা খুব গুরুত্বপূর্ণ। ক্যান্সার হলেই জীবন শেষ, এখন আর এমনটা নেই। শুরুতে ধরতে পারলে, ডায়াগনোসিস করতে পারলে অনেকে বেঁচেও যাচ্ছে। যেটা বললাম সচেতনতা... যেটার সঙ্গে সাকিবের নাম আছে, সচেতনতা তৈরির জন্য এর চেয়ে ভালো কিছু হতেই পারে না। বাংলাদেশের সাকিবের নাম অবশ্যই একটা প্লাস পয়েন্ট, এই সচেতনতার উদ্যোগটা সফল করার জন্য।” “আমি শুধু এটুকু বলব, সাকিবের এই উদ্যোগ একটা মহতী উদ্যোগ। অবশ্যই আমাদের সাহায্য থাকবে যে কোনো সময়, যেখানে যা লাগে। একটা সুবিধা আছে, আমি আবার ওষুধ শিল্প সমিতিরও সভাপতি। অবশ্যই ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি যারা ওষুধ বানাচ্ছি বাংলাদেশে, তারা তোমাদেরকে; এই প্রতিষ্ঠানকে যখন যা দরকার সাহায্য করবে। এই ব্যাপারে আমি কথা দিচ্ছি। আমার তরফ থেকে শুধু সাকিব নয়, এটার সঙ্গে যারা যারা জড়িত আছে, সবাইকে বলে রাখছি। পূর্ণ সমর্থন সবসময় পাবে।”
সমাপনী বক্তব্য রাখেন এই ফাউন্ডেশনের মূল উদ্যোক্তা কাফি। শুরুর দিকে ক্যান্সারে আক্রান্ত বাচ্চাদের নিয়ে কাজ করার কথা জানান তিনি। পর্যায়ক্রমে বৃহৎ পরিসরে কাজ শুরুর আশা ব্যক্ত করেন বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৯ দলের সাবেক এই অধিনায়ক।
তথ্যসূত্র: বিডিনিউজ২৪.কম
ছবি: যমুনা টিভি ও রাইজিং বিডি